গ্ৰান্ড ইন এড প্রথা ও ম্যাডোনা কার্টার সম্পর্কে লেখো? উডের ডেসপ্যাচের ঔপনিবেশিক চরিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
গ্র্যান্ট-ইন-এড প্রথা
1854 খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি আর্থিক সাহায্য দিয়ে উৎসাহ দেওয়ার জন্য গ্র্যান্ট-ইন-এড (Grant-in-Aid) প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশ অনুযায়ী এদেশে সর্বপ্রথম Grant-in-Aid প্রথা চালু হয়েছিল। সরকার বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে অর্থ দিয়ে শিক্ষাবিস্তারের জন্য সাহায্য করে। এর জন্য কতকগুলি শর্ত আরোপ করা হয়-
1. ধর্মনিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে।
2. স্থানীয় পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে।
3. সরকারি পরিদর্শনের অধিকার স্বীকার ও পরিদর্শকের নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
4. ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য বেতন নেওয়া হবে।
উডের ডেসপ্যাচকে ম্যাগনা কার্টা বলার কারণ
স্যার চার্লস উড ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে 1854 খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচ নামে একটি মূল্যবান দলিল বা নির্দেশিকা রচনা করেন। উডের ডেসপ্যাচকে ভারতীয় শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা (Magna Carta) বলা হয়। কারণ এর লক্ষ্য ছিল ভারতের জনগণকে আরও শিক্ষার স্বাধীনতা দেওয়া এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর মাধ্যমে ভারতীয়রা আর ইংরেজির অধীন ছিল না। উডের ডেসপ্যাচ প্রকাশিত হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই-এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তাই ইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টা বা মহাসনদের অনুকরণে উডের ডেসপ্যাচকে ম্যাগনা কার্টা বলা হয়।
উডের ডেসপ্যাচের ঔপনিবেশিক চরিত্র
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মূল লক্ষ্য হলো শাসিত অঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করে তাকে শোষণের উপযোগী করে তোলা। কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন শাসনব্যবস্থা বা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য একটাই— শাসক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষেত্রে এই মনোভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। ভারতের প্রশাসন, অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সবই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
ইংল্যান্ড এদেশে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিল যারা অল্প বেতনে সরকারি কাজ করবে, শাসকদের নির্দেশ মেনে চলবে এবং ব্রিটিশ নীতিকে সমর্থন করবে। পাশাপাশি ভারতের কাঁচামাল যেন অবিরাম ব্রিটেনে পৌঁছায় এবং ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য ভারতের বাজারে বাধাহীনভাবে বিক্রি হয়—এই লক্ষ্যেই তাদের সরকারি নীতি পরিচালিত হতো। শিক্ষানীতিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
এই প্রেক্ষিতেই ১৮৫৪ সালের উডের ডেসপ্যাচ প্রণীত হয়। যদিও এটি মূল্যবান একটি শিক্ষাদলিল, কিন্তু এর ভেতরে ব্রিটিশদের বণিকসুলভ ও ঔপনিবেশিক মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। ডেসপ্যাচে শিক্ষার এক অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল— ভারতের কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ব্রিটিশ পণ্যের জন্য ভারতীয় বাজারে স্থায়ী চাহিদা তৈরি করা। এতে স্পষ্ট যে ডেসপ্যাচের পেছনে ভারতীয়দের প্রকৃত উন্নয়ন নয়, বরং ব্রিটেনের বাণিজ্যিক স্বার্থই মুখ্য ছিল।
কোম্পানির উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না ভারতীয়দের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখানোর মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি ও সমাজকে উন্নত করা। ডেসপ্যাচে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে স্পষ্ট বলা হয়েছিল— “শিক্ষার মাধ্যমে এমন দক্ষ, নৈতিক, বিশ্বস্ত ও অনুগত সরকারি কর্মচারী তৈরি হবে, যারা কোম্পানির কাজে লাগবে।”
অর্থাৎ ভারতীয়দের শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যও ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনকে শক্তিশালী করা।
তবুও স্বীকার করতে হয়, ঔপনিবেশিক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও উডের ডেসপ্যাচ ভারতের জন্য কিছু সুফলও বয়ে এনেছিল। এতদিন ব্রিটিশ ভারতে কোনো সুসংহত শিক্ষানীতি ছিল না। উডের ডেসপ্যাচ প্রথমবারের মতো প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রদান করে এবং পরবর্তী শিক্ষানীতি গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে।
উপসংহার :
উডের ডেসপ্যাচের মূলে ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষা, তবে তার পাশাপাশি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোও প্রদান করেছিল।
